এই দেশে, (ক্যানাডায়) কর্মস্থলে সারাক্ষন আমাদের শেখানো হচ্ছে অন্যের অবস্থানে, অর্থাৎ সহ কর্মীদের অবস্থানে দাঁড়িয়ে বিবেচনা করতে হবে, আমার সাথে যারা কাজ করছেন ওদের কথা, অবস্থা, ঘটনা ইত্যাদি চিন্তা করতে হবে। স্বার্থপরের মতো শুধু আমার যা প্রয়োজন তা করলেই হবে না। একে বলা হয় perspective taking, “an understanding of other people's mental states” (their thoughts, feelings, desires, motivations, intentions).
মনে করুন আমার অফিসের জেরী এসে বলল, -আজকে গাড়ীটা রাস্তায় হেঁচকি তুলে দাঁড়িয়ে গেল, পরে অনেক কষ্টে ওটাকে ট্রাক দিয়ে টেনে মেরামতের জন্যে গেরাজে নিয়ে গেছি, আমাকে কাজ থেকে একটু তাড়াতাড়ি বের হতে হবে। মনে মনে বলি, ব্যাটা বজ্জাত, রোদেলা বিকেলেই শুধু তোমার গাড়ী হেঁচকি তোলে? সারা শীতকাল তুষার ঝড়ের মধ্যে একবারও গাড়ী হেঁচকি তোলেনি, গত সপ্তাহে তোমার গাড়ীর পেছনের সীটে কি আমি গল্ফের ক্লাব গুলো দেখি নাই মনে কর, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু আমরা এখন অন্যের অবস্থান থেকে বিবেচনা করতে শিখেছি। আমি তখন হয়ত বলব, -সে কি দুঃখের কথা, চল আমিই তোমাকে নিয়ে যাই গাড়ী মেরামতির যায়গায়। সে অনেকবার মানা করেছে, কিন্তু আমার একবার বড্ড ইচ্ছা ব্যটাকে ধরার, ঠিক ব্যাটে-বলে হচ্ছেনা।
পুরুষ কর্মী হয়ে, সাথের মহিলাদের অবস্থানে দাঁড়িয়ে বিবেচনা করা আরো বেশী কঠিন, স্টেসি এসে করুন কন্ঠে জানালো ওর ছেলে আড়াইবার হেঁচেছে। ২০ বছর আগের বাংলাদেশ হলে বলতাম, -কাজের বুয়াকে দিয়ে দুইটা রাস্তার মালাই আইস্ক্রিম খাইয়ে দিন সব ঠিক হয়ে যাবে। এখনও মনে পড়ে বড় মেয়েকে জরুরী কারণে ডাক্তার দেখিয়ে অফিসে আসতে ঘন্টা খানেক দেরী হয়েছিল বলে আমার শেতাঙ্গ বড় সাহেব অনেক ঝাড়ি দিয়েছিলেন। কিন্তু দিন বদলেছে, এখন ওরকম কথা বললে কুচ করে নিজের চাকরীটাই কচুকাটা হয়ে যাবে। মনে রাখবেন আমি এ যুগের মায়ের অবস্থানে দাঁড়িয়ে কথা বলছি? তাই একটা আতংকিত চেহারা নিয়ে স্টেসিকে বলতে হবে, -এত মোটেই ভাল খবর না, তুমি কি করবে ভাবছো? এ কথা শুনেই হয়ত স্টেসি নাকে-চোখে রুমাল দিয়ে ঢেকে ফুঁপিয়ে বলবে, -আমার মাসুম বাচ্চাটা কেন আড়াইবার হাঁচলো কিছুই বুঝিনা… হায় ভগবান সাহায্য কর। মনে মনে আমিই তখন বলছি, ভগবান আমারই আসলে সাহায্য লাগবে, আমি লাইনে ঐ মেয়েটার আগে, অনুগ্রহ করে বিবেচনা কর। ইংরেজী ছবির মত এমন দৃশ্যে, এক হাতে কফির মগ নিয়ে অন্য হাতের বুড়ো আঙ্গুলটা প্যান্টের সাস্পেন্ডারে ঝুলিয়ে রুমের মধ্যে পায়চারী করে বললাম, -কিচ্ছু চিন্তা কোরনা, একটা কিছু ব্যাবস্থা হয়ে যাবে।
গম্ভির মুখে স্টেসির পাশের কিউব থেকে রাজনী কে রুমে ডেকে আনলাম, গভীর উৎকন্ঠার চেহারা নিয়ে অবস্থাটা বুঝিয়ে বললাম। রাজনীও কম যাবে কেন? ওর কি ঠেকা পরেছে ঐ সব অন্যের অবস্থানে বসে দেখার, সে বেশ ঠাস ঠাস করেই বলে ফেলল, -আমি সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত কাজে ডুবে আছি। মনে মনে বলি, তাহলে ডেস্ক এর উপর নেইল ফাইল আর কাগজের পিছনে নেইল পালিশ রিমুভার কেন? ওই গুলো দিয়ে কি কাজ করা হয়? কিন্তু আজকের যুগে ও সব বলা যাবেনা, বললেই বিপদে পড়তে হবে। তাই গলায় অপর্যাপ্ত শক্তি টেনে বলতেই হয়, -আসলে বলতে চেয়েছি, আমরা সবাই এক সাথে অবস্থাটা সামলে নেব । স্টেসি আর রাজনীকে বিদায় করে কাজে বসলাম।
কপাল সত্যিই খারাপ, এর মধ্যে হন হন করে বড় সাহেব, অর্থাৎ আমার ভিপি, এসে ঘরের দরজা বন্ধ করে সভা করার গোল টেবিলটার পাশে চেয়ার টেনে বসলেন। আমার ঘাড়ে কয়টা মাথা আছে? তাই বাধ্য হয়ে নিজের এক মাত্র মাথা এবং চেয়ারটাও ঘুরিয়ে অপরিকল্পিত এই বৈঠক এ যোগ দিতে হল। মহিলা উচ্চতায় ছয় ফুট দুই, বয়সের সাথে সাথে বিশাল বপু ধারন করেছেন। ওনার লম্বা হাত কে কোঁৎকা বানিয়ে আমার ঘাড় মটকে ধরলে এই ক্ষুদে বাঙ্গালী পাঁচ সেকেন্ডে ইহধাম ত্যাগ করতে বাধ্য। গলা খাদে নামিয়ে উনি জানালেন, -অ্যান্ডির মনে হয় এবার বিক্রির লক্ষটা ফস্কে যাচ্ছে, আমার ওকে একটু সাহায্য করতে হবে, আগামীকাল শহরের বাইরে বড় খদ্দেরটার সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। আমি চাই তুমি এ সুযোগে কাস্টমার সার্ভিস আর প্রমোশন্স এর সাথে কথা বলে বাজেট এর ব্যপারটা সামলে নাও, আমি পরশু দিন এসে ওটা নিয়ে আলাপ করব। মনে এসে যায়, ও বুঝেছি ঐ খদ্দের এর অপিসের দুই কিলোমিটার দূরেই তো ক্যাসিনো, দু-চার দান রুলেট আর পোকার টেবিলে পানাহারের সাথে বিক্রির কাঁটা যে একটু উপরের দিকে উঠবে তা অবাক হবার আর কি আছে? আর ঐ দুই ম্যানেজার কে নিয়ে আমি পড়লাম বিপদে, এমন পিচ্ছিল যে ছাই দিয়ে শিং মাছের মত না ধরা পর্যন্ত কোন কাজই আদায় করা যায় না, বিপদ আর কাকে বলে। কিন্তু আমাকে এখন বড় সাহেবের অবস্থানে থেকে দেখতে হবে, তাই বললাম, -আরে খদ্দের হল সব কিছু, তুমি খদ্দের সামলাও আমি এদিকটা ব্যাবস্থা করে রাখছি।
এতক্ষনে মনে পড়েছে, বিবি সাহেব আমাকে আজকে ছয়টার মধ্যে বাড়ী থাকতে বলেছেন উনি বাজারে যাবেন বাচ্চারা বাসায় থাকবে, তার মানে পাঁচটায় কাজ থেকে বের হতে হবে, কি বিপদ! দুই ম্যানেজারকে আগামী কাল সভায় ডাকলাম, ফোন পেয়ে ওনাদের ভাব যেন ১০৪ ডিগ্রী জ্বর এসেছে, এবার ওনাদের অবস্থান থেকে চিন্তা করে, আমি নিজেই কিছুটা কাজ করে সাহায্য করব বলে জানালাম। স্টেসি, জেরি আগে এবং রাজনী সময় মত বাড়ী চলে যাওয়ার এক - দেড় ঘন্টা পরে সব শেষ করে অফিস থেকে বেরিয়ে বাড়ী গিয়ে পৌঁছালাম। মনে বড় আশা পরিবারের কেউ এখন আমার অবস্থানে বসে বিবেচনা করবে। আশাকরী এতক্ষনে perspective taking এর বিটকেলে ব্যাপারটা অল্প করে হলেও বুঝাতে পেরেছি, এবার এর সাথে আমার সংসারের যোগাযোগটা কোথায় সেটাই আমার মূল আলাপের বিষয়।
বাড়ীতে ঢুকেতেই, বিবি সাহেব বের হয়ে গেলেন বাজার করতে, কিঞ্চিত অসন্তুষ্ট, কিন্তু আমারই বা কি করার উপায় ছিল। ওনার নির্দেশ মত মেয়েদের সাথে রাতের খাওয়া শেষ করে ওদের দাঁত মাজা ইত্যাদি কাজ সম্পন্ন করা তদারকি করলাম। আমাদের বাড়ীতে একটা সুন্দর নিয়ম তৈরী হয়েছে, মেয়েরা ঘুমাতে যাওয়ার আগে কিছুক্ষন আমার সাথে বিছানায় শুয়ে শুয়ে গল্প করে, বাবার গলা জড়িয়ে ধরে, আদর করে দেয়, সারা দিনে এই সময়টার জন্যে আমি অপেক্ষা করে থাকি, বাবা হিসেবে এটা আমার প্রতিদিনের অমূল্য সওগাত। সেদিনও দুই মেয়ে আমার দুই পাশে শুয়ে গল্প করছে। বড় জন মায়ের মত, একটু চুপচাপ, একটু পড়ুয়া গোছের, জনতার উপকারে সদা মনযোগী, কিন্তু বাড়ীর কাজের কথা বললে ঘুমিয়ে পড়ে, ওর মা মনে করে এই শেষের টুকুই, অর্থাৎ ঘুমটুকুই শুধু আমার কাছ থেকে ও পেয়েছে। জানেন নিশ্চয়, পড়ুয়ারা একটু বেশী ঘুমায়, অনেক চিন্তা করতে হয় তাই ঘুম খুব জরুরী। কিন্তু মেয়েদের যা কিছু খারাপ, ওদের মা মনে করে সব বাবার কাছ থেকেই এসেছে। ছোট জন বেশীরভাগ আমার মত, হৈ হৈ জনতা, তবে বুদ্ধির কিছু ভাগ মায়ের কাছ থেকেও পেয়েছে। মজার কিছু শুনলে তিনবার হো হো করে হাসে, প্রথমবার সবার সাথে, দ্বিতীয় বার বুঝে উঠবার পর আর সর্ব শেষবার গোসলখানায়। আমাদের পরিবারে একমাত্র ওই এখন গোসল করার সময় হাসে, কথা বলে, আমার মা কাছে থাকলে বলতেন একদম আমার ছোটবেলার মত।
সেদিন গল্প প্রসঙ্গে হঠাৎ বাড়ীতে জন্তু পোষার আলাপ চলে এলো, বড় জন বেড়াল পুষতে চায় আর ছোট জন কুকুর ছানা। বড় মেয়ে কথাটা পরিবেশন করল খুব সুন্দর করে, -বাবা জানো এখন এলার্জি হয় না এরকম বেড়াল পাওয়া যায় আমরা একটা বেড়াল ছানা পোষা শুরু করতে পারি তোমার কোন কষ্টই হবেনা, তোমার মতামত কি বাবা? ছোটই বা কম যাবে কেন? সে আবার বলে উঠল, -বেড়াল ছানাটা যে একদম একা হয়ে যাবে, ওটার সাথে খেলবার জন্যে একটা কুকুর ছানাও দরকার। বেড়ালের লোমে আমার ভীষণ এলার্জি আর কুকুরকে আমি খুব ভয় পাই, সে যত ছোট কুকুরই হোক। তাই মেয়েদেরকে আগেই একবার বলেছি বাড়ীতে বেড়াল বা কুকুর পোষা সম্ভব নয়। আমি দিব্য দৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছি বেড়ালটা বড় মেয়ের সাথে কুন্ডুলি পাকিয়ে ঘুমাচ্ছে আর খেয়ে খেয়ে মোটা হচ্ছে, আর কুকুর ছানাটা ছোট মেয়ের সাথে সারা বাড়ী দৌড়ে ঝাঁপিয়ে তছনছ করে দিচ্ছে। ভাবলাম আমার অবস্থান থেকে ওদের কে বোঝালে হয়তো বুঝবে, বাবার জন্যে দুজনেরই খুব মায়া।
শুরু করলাম এভাবে, -জানিস ছোট বেলায় আমারও পোষা অনেক কিছুই ছিল। দুই মেয়েই এক সাথে শুনতে আগ্রহী, ছোট জন একটু বেশী আগ্রহী, বড় জন সন্দেহ করছে আমি ব্যাপারটা অন্য খাতে নেয়ার চেষ্টা করছি। ছোট জন বলে উঠল, -বাবা তোমার কি পোষা ছিল? বললাম অনেক কিছুইতো ছিল, প্রথমে ছিল একটা মোরগ। দুই মেয়েই সমস্বরে বলে উঠল মোরগ! বড় জন একটু বেশী জ্ঞানী, আমাকে বলে বসল, -তুমি ঐ মোরগটা দিয়ে মোরগ লড়াই করতে নাতো? ওটা কিন্তু প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতা। আজকাল বাচ্চাদের সাথে কথা বলতেও মেপে বলতে হয়, কি বিপদে পড়ি, তাই ওদের অবস্থানে দাঁড়িয়ে চিন্তা করে বললাম, -না ওটা আমার সাথে খেলার মাঠে যেত, বাড়ীর মুরগী গুলো কে দেখে রাখতো আর অন্য বাড়ীর মোরগদেরকে দূরে রাখতো। ছোট এবার জানতে চায়, -তুমি কি ওটাকে নিয়ে ঘুমাতে? -নাহ ওটা রাতে খোয়াড়ে রেখে আসতাম, অন্য মুরগীদের সাথে। আর সকালে উঠে ও কুক্কুরুকু ডেকে সবাইকে ঘুম থেকে তোলার কাজ ছিল তাই সাথে রাখতে পারতাম না। দুইজনই বেশ আশাহত, -তাহলে আর পোষা হল কেমন করে? বুঝিয়ে বললাম ওটাতো সারাদিন আমার সাথেই থাকতো, আমিই ওটাকে খানাপিনা দিতাম। পরের প্রশ্ন, -তারপর কি হলো? জানালাম ওটাকে প্রায় বছর খানেক পুষেছিলাম, কিছু মজার ঘটনা শোনালাম। এবার ওরা মোরগ কাহিনীর শেষ জানতে চায়, ছোট মেয়ে বললো, -এরপরে মোরগটা কি বনে-জঙ্গলে হারিয়ে গেছিলো? অরে নাহ, -একদিন তোদের দাদুমনি ওটাকে রোস্ট বানিয়ে ফেলেছিল। মেয়েরা মোরগ কাহিনীর এমন যবনিকা আশা করেনি, সমস্বরে বলে উঠল, -রোস্ট বানালো আর তুমি ঐ রোস্ট খেলে? বেশ নিরাসক্ত গলা নিয়ে বলতেই হলো, -কি করবো দাদুমনির কথা শুনতেই হতো, উনিতো আমার মা তাইনা। কি করে বোঝাই ব্যাটা মোরগ খেয়ে খেয়ে দেড় বছরে এমন মোটা হয়েছিলেন যে উনার পুরুষালী কাজকর্মে অবনতি দেখা যাচ্ছিল, গত বার ছয় খানা ডিমে মুরগী তা দিয়ে তিন সপ্তাহ পর মাত্র দুটো বচ্চা ফুটলো, বাকি চারটা ডিমই পঁচে গেল। সেই থেকে মা ওটার ওপর চোটে ছিলেন। উপজেলা শহরে সরকারী কর্মকর্তার বাড়ীতে হঠাৎ আত্মীয় কুটুম্ব বেড়াতে আসলে ঐ মোরগ এর উপর যে মায়ের চোখ পড়বে এ আর আশ্চর্যের বিষয় ছিলনা। অতঃপর খালুর আসার খবর পেয়ে মোরগ বেচারা টেবিলে রোস্ট হয়ে উঠে এলেন, কিন্তু মেয়েদের অবস্থানে এটা কেমন করে গুছিয়ে বলি তাই বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
মেয়েরা আমার পোষা প্রাণীর ব্যাপারে বেশ আশাহত বলেই মনে হলো, বড় মেয়ে বুঝিয়ে বললো, -বাবা ওটা হলো খাওয়ার জন্য কয়দিন বাড়ীতে রেখে বড় করা। আমি বললাম, -কিন্তু আমাদের দেশেতো ওটাকেই পোষা বলে, আমি প্রায় নিশ্চিত এদেশের গ্রামের লোকরাও এই কাজ করে। দুজনই সিদ্ধান্তহীন, দ্বিধাগ্রস্ত, আসলেই কি একে পোষা প্রানী বলা যাবে? ছোট এবার বলে উঠল, -এরপর কি পুষলে? আমি বেশ উৎসাহ নিয়ে বললাম, -মাছ, তোদের দাদাভাই তখন বদলী হয়ে পদ্মার পাড়ে পাকশীতে গেলেন, আমাদের সরকারি কোঠার পেছনে ছোট্ট একটা স্বচ্ছ পানির ডোবা ছিল, ওটাতে হাতেম মালী ভাই এর বুদ্ধিতে মাছের পোনা ছেড়ে ছিলাম। এবার ওরা বেশী আশা করছেনা বুঝতেই পারছি, তবুও ছোট মেয়ে মিনমিনে গলায় বললো, -গোল্ড, টাইগার, ক্লাউন ফিশ অমন কিছু ছেড়ে ছিলে বুঝি? বুঝিয়ে বললাম, -আমাদের দেশে ওগুলো পাওয়া যেত কিনা জানিনা, আমরা তেলাপিয়া, কৈ, পুঁটি, দুই একটা রুই মাছের পোনা ছেড়ে ছিলাম বলে মনে পড়ে। বড় জন এবার আগে থেকেই বলে উঠলো -ওগুলো কয়দিন পরে কি খেয়ে ফেলেছিলে? বললাম, -তা বৈকি? মাছ গুলোতো বড় করাই হচ্ছিল খাওয়ার জন্যে, আমি স্কুল থেকে এসে ছিপ ফেলে কয়টা মাছ ধরে আনতাম দাদুমনি ওগুলো আমাদের রাতের খাওয়ার সাথে রান্না করে দিতেন। বড় এবার বেশ বিজ্ঞের মতো বলে উঠলো, -বুঝেছি তোমাদের সময় বাচ্চারা জীব জন্তু পোষার মূল উদ্দেশ্যই ছিল বড় করে খাওয়া। বললাম, মনে হয় অনেক খানি ঠিক ধরেছিস। শেষ পর্যন্ত মেয়েরা আমার অবস্থান থেকে চিন্তা করতে পারছে ভেবে বেশ ভাল লাগছিল, কিন্তু ছোট জন কেমন যেন ভয় পাওয়া ফ্যাকাসে হয়ে থাকছে, জিজ্ঞেস করলাম, -তোর কি হলো, কি বুঝলি ? খুব ভীতু গলায় বললো, -তাহলে আমরা যদি কুকুর - বেড়াল পুষতে শুরু করি আর বাংলাদেশে আমাদের পোষাদের নিয়ে যাই আমাদের কি ঐ কুকুর আর বেড়াল খেতে হবে?
আমি যেন চোখের চারপাশে সর্ষের ফুল দেখতে শুরু করলাম হাসবো না কাঁদবো, আমার অবস্থান থেকে চিন্তা করার এই দুর্গতিহবে ভাবতেও পারি নাই। মনের ভেতরে অকৃতকার্য হবার এক অব্যাক্ত বেদন। বোঝানোর চেষ্টা করলাম কুকুর বা বেড়াল কি কেউ খায়? এ সময় বিবি সাহেব এর আগমন, উনি এসে জানালেন আমি দেরী করে আসার কারণে ঠিক মতো বাজার করতে পারেননি। কাছের দোকান থেকে চড়া দামে কোন ক্রমে কয়দিনের রসদ জোগাড় করেছেন, বাজার খরচা পড়েছে প্রায় দ্বিগুনের মত। আমার মাথা ততক্ষনে ঝিম ঝিম করতে শুরু করেছে। থাক আমার অবস্থান থেকে কেউকে চিন্তা করতে হবেনা, আমি এখন ঘুমাতে পারলেই আমার মাথাটা এ যাত্রা পরিত্রান পায়। পার্স্পেক্টিভ টানা পোড়নে আমার আমিত্ব যেন হারিয়ে গেল।